প্লাস্টিকের বর্জ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে বাড়ি, ক্লাসরুম
ইঁট কাঠ বালি সিমেন্টের বাড়ি না বানিয়ে, প্লাস্টিকের বাড়ি তৈরি
করলে কেমন হয়? পৃথিবীতে যত প্লাস্টিকের বর্জ্য সৃস্টি হয় প্রতিদিন, তার খানিকটা কাজে
লাগিয়ে ইঁট তৈরি করা যায় না কি?
প্লাস্টিকের আবর্জনা এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফেলে-দেওয়া
প্লাস্টিক এখন ছড়িয়ে আছে সর্বত্র – পাহাড়ে, সমুদ্রে, নদী-নালায় চাষের খেতে, প্রাণীদের
পেটে। এমনকি মানুষের রক্তেও মিশছে প্লাস্টিকের অতি সূক্ষ্ম কণা।
অথচ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। সেই সঙ্গে
বেড়েই চলেছে তার বর্জ্যের পরিমাণ। ফেলে-দেওয়া প্লাস্টিক আবার কিভাবে ব্যবহার করা যায়,
তাই নিয়ে চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
ইতিমধ্যেই প্লাস্টিকের বাড়ি তৈরি করতে শুরু করেছেন হায়দ্রাবাদেরএক দম্পতি – প্রশান্ত লিঙ্গম ও তাঁর স্ত্রী অরুণা। বাড়ি আর ঘরের আসবাবপত্রের ডিজাইন
বা নক্সা তৈরি করায় তাঁদের ছিল অনেক দিনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু একটা বিশেষ ঘটনা তাঁদের
প্লাস্টিকের বাড়ি তৈরি করায় উদ্বুদ্ধ করে।
‘হিন্দুস্থান টাইমস’কে প্রশান্ত বলেন যে তাঁরা একটা ভিডিও দেখেন,
যাতে অপারেশন করে একটি গরুর পেট থেকে প্লাস্টিকের আবর্জনা বার করা হচ্ছিল। সেই দৃশ্য,
তাঁদের বিচলিত করে। কি করে প্লাস্টিকের বর্জ্য একটু হলেও কমানো যায়, তার উপায় খোঁজেন
তাঁরা এবং পথও বার করে ফেলেন। ঠিক করেন, ফেলে-দেওয়া প্লাস্টিক দিয়ে বাড়ি তৈরি করবেন।
প্রথমে তাঁরা দুধের প্যাকেট দিয়ে তৈরি করেন কাঠের প্লাইয়ের
মত শক্ত বোর্ড। প্রশান্ত বলেন তাই দিয়ে তৈরি করা যায় ফার্নিচার, টেবিল চেয়ার, বাথরুম,
বেঞ্চ এবং বাস স্ট্যান্ডের ছাউনি।
হায়দ্রাবাদের উপ্পল এলাকায় ওই দম্পতি প্রথম বাড়িটি তৈরি করেন।
৮০০ বর্গ ফিটের বাড়ি। তার জন্য ব্যবহার হয় ৭ টন প্লাস্টিক। প্রশান্ত বলেছেন, বাড়িটি
তৈরি না হলে, ওই পরিমাণ প্লাস্টিক গিয়ে মিশত মাটিতে। উনি স্বীকার করেন যে, প্লাস্টিকের
বাড়ি সম্পর্কে একটা ভয় কাজ করে মানুষের মনে। হয়তো সেটাই স্বাভাবিক। কিন্ত প্রশান্ত
বলেন, ইঁট-সিমেন্টের বাড়ির মতই শক্তপোক্ত হয় প্লাস্টিকের বাড়ি। তাঁর দাবি জল, আগুন
আর গরম প্রতিরোধ ক্ষমতা-সম্পন্ন হয় সেগুলি। তাই অনায়াসে টিকে যায় ৩০/৪০ বছর। তাছাড়া,
ফুটপাথে বসানর জন্য প্লাস্টিকের আবর্জনা দিয়ে তৈরি করছেন প্লাস্টিকের টালিও। তেলাঙ্গানা
সকার তাঁদের এই পয়াসকে নানা ভাবে সমর্থন করছেন, বলেন প্রশান্ত।
আবার, প্লাস্টিক দিয়ে বাড়ি তৈরি করার নানা উপাদান বানানো যায়
কিনা, তাই নিয়ে আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট ইউনিভারসিটিতে গবেষণা করছেন ব্রেজিলের বিজ্ঞানী
সেবেল সেস্তারি।
বিবিসি’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি লেখায় উনি বলেছেন, যে পরিমাণ
প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয় প্রতি বছর তার একটা ক্ষুদ্র অংশই রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার
করা হয়। ব্রিটেনের উদাহরণ দিয়ে উনি বলেছেন, সে দেশে প্রতি বছর ৫৫ লক্ষ টন প্লাস্টিক
বর্জ্য সৃষ্টি হয়, কিন্তু আবার কাজে লাগানো হয় তার মাত্র চার লক্ষ টনের মতো।তার কারণ,
মনে করা হয় বেশির ভাগ প্লাস্টিকের আবর্জনাকে পুনর্ব্যবহার করা যায় না।
সেস্তারি অবশ্য তা মনে করেন না। তাঁর মতে সব পলিমার, যা থেকে
প্লাস্টিক তৈরি হয়, তা পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব। কিছু ধরনের প্লাস্টিক তো বার বার ব্যবহার
করা যায়। তবে উনি বলেছেন যে, রিসাইকেল করার সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্লাস্টিকের গুণমান কমে
যায়। তখন সেগুলিকে নতুন প্লাস্টিকের সঙ্গে মিশিয়ে, তাদের মান আবার উন্নত করা সম্ভব।
সেস্তারি অনেক রকম পরীক্ষা করে চলেছেন। প্লাস্টিকের আবর্জনা
গলিয়ে তার সঙ্গে আখ, কফি ও নির্মাণ শিল্পের বর্জ্য, কাঠের গুঁড়ো, এমনকি লাল মাটি মিশিয়ে
তৈরি করছেন বাড়ি তৈরির বিভিন্ন উপাদান – ইঁট, টালি, বিম ইত্যাদি। তবে সে সব জিনিস এখনও
বাজারে আসেনি। আসতে সময়ও লাগবে। কারণ যতক্ষণ না দেশে দেশে সরকার ওই নতুন ধরনের প্লাস্টিকের
জিনিস ব্যবহারে উৎসাহ দেখাচ্ছে, তত দিন তার উৎপাদন লাভজনক হবে না। তবে উনি বলেছেন যে,
নানা দেশে প্লাস্টিক বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারের অভিনব সব চেষ্টা চলছে। এমনকি তা দিয়ে
রাস্তা তৈরি করেও দেখা হচ্ছে তা কতটা টেকসই ও ব্যবহার যোগ্য হতে পারে। আর জাপানে তৈরি
হয়েছে এমন এক মেশিন যেটি ফেলে-দেওয়া প্লাস্টিক থেকে বার করে আনছে জ্বালানি। উল্লেখ
করা যেতে পারে, এই রাস্তা তৈরির কাজে রিসাইকেল-করা প্লাস্টিকের আংশিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে
দক্ষিণ ভারত অনেকটাই এগিয়ে আছে।
অন্যদিকে, ‘ফ্রান্স২৪.কম’-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে
যে, আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্টে প্লাস্টিকের ইঁট দিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে তৈরি হয়েছে ন’টি
প্লাস্টিকের ক্লাসরুম। ইউনিসেফ আর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলোম্বিয়ার একটি কম্পানি, ‘কনসেপ্টস
প্লাস্টিকোস’, যৌথভাবে প্লাস্টিকের ক্লাসরুমগুলি তৈরি করেছে আফ্রিকার আইভরি কোস্টে-এ।
কলোম্বিয়ার রাজধানী বগোটায়, বাড়ি তৈরির সরঞ্জাম ইতিমধ্যেই পরীক্ষামূলক
ভাবে তৈরি করছে ওই কম্পানি। ইউনিসেফ হল রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেই বিভাগ যারা বাচ্চাদের জন্য
কাজ করে। তারা বগোটার ওই উদ্যোগকে কাজে লাগিয়েছে আফ্রিকার আইভরি কোস্টে, বাচ্চাদের
সুন্দর ও কম খরচে ক্লাসরুম তৈরি করার জন্য। মনে করা হচ্ছে, আফ্রিকার নানা দেশে ওই রকম
স্কুলঘর তৈরি করা যেতে পারে।
নতুন প্লাস্টিকের ক্লাসরুম কেমন লাগছে পড়ুয়া আর শিক্ষকদের?
প্লাস্টিকের ঘর তাদের দারুন লেগেছে। আগের ঘর আর এগুলির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ, মনে
হয়েছে তাঁদের।
Comments
Post a Comment