অরণ্য-স্নান: সুস্থ থাকার জাপানি প্রথা

 

কিঙ্গ লি

শেষ কবে গিয়েছিলেন গাছেদের কাছে? মনে পড়ে কি সেই জায়গাটা, যেখানে গাছেরা দল বেঁধে থাকে। ডালপালা মেলে আলিঙ্গন করে থাকে একে অপরকে। ফুল ফোটে। বুনো ঘাস গজায় তাদের পায়ের চারপাশে। কাঠবেড়ালিরা ছুটোছুটি করে খেলে বেড়ায়। পাখিরা ডাকে নানা সুরে। গিরগিটি গাছে উঠতে গিয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ঢুলুঢুলু চোখে সব দিক দেখে নিয়ে রঙ বদলায়। আপনার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে মাটি আর ফুলের গন্ধ প্রবেশ করে আপনার শরীরে।

শরীর ও মন ভাল রাখতে হলে, গাছেদের কাছে যাওয়া, তাদের সঙ্গে মেলামেশা করা, খুব জরুরি। এ কথা বলেছেন জাপানি বিজ্ঞানী কিঙ্গ লি, যিনি ‘ফরেস্ট বেদিং’ বা ‘অরণ্য-স্নান’ বলে একটি বই লিখেছেন। নিপ্পন মেডিক্যাল স্কুলের সঙ্গেও যুক্ত উনি। অনেক রকমের স্নানের কথা আমরা জানি - ঠাণ্ডা জলে স্নান, গরম জলে স্নান, পুকুরে স্নান, নদীতে স্নান, সমুদ্রে স্নান, বালি-স্নান, পলি-স্নান এমনকী রৌদ্র-স্নান। কিন্তু অরণ্য-স্নান অনেকের কাছেই নতুন ঠেকবে।

এই প্রথাটা জাপানের নিজস্ব। কিঙ্গ লি বলেছেন সে দেশে ‘শিনরিন-ইয়োকু’ বলে একটি শব্দবন্ধ আছে। ‘শিনরিন’ শব্দটির মানে হচ্ছে বন বা অরণ্য আর ‘ইয়োকু’র মানে স্নান। ফলে, দুয়ে মিলে হয় ‘অরণ্য-স্নান’।

কিন্তু এর মানে কি? গাছপালা, ঘাস, মাটি, জল কি গায়ে মেখে নিতে হবে? না, ঠিক
তা না হলেও, ব্যাপারটা তার কাছাকাছি। কিঙ্গ লি বলেছেন, এর অর্থ হল শরীরের সব ইন্দ্রিয় দিয়ে অরণ্যের সব কিছু আত্মস্থ করা। গাছপালার রঙ, বনের বাতাস, মাটির গন্ধ, সেখানকার নানা শব্দ, নিস্তব্ধতা, আলো-ছায়া, প্রাণীদের উপস্থিতি, সব কিছু উপভোগ করতে হবে। উনি বলেছেন অরণ্যকে আত্মস্থ করার ব্যাপারটা কী, তা বলে বোঝানো কঠিন। তবে যা বলা যায় তা হল, প্রকৃতির বৈচিত্রময় শোভা আহরণ করা। এতে কোনও এক্‌সারসাইজ বা শারীরিক কসরতের প্রয়োজন নেই।  এতে ট্রেকিং বা জগিং-এরও কোনও স্থান নেই। কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতাও নেই। শুধু গাছেদের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে নিজের ইচ্ছে মতো হাঁটলেই হবে। এমনকী চুপচাপ বসে থাকলেও ক্ষতি নেই।  মূল কথা হল, নিজের প্রতিদিনকার ব্যস্ততা থেকে নিজেকে কয়েক ঘন্টা আলাদা করে নি
য়ে গাছেদের, ঘাসেদের, লতাগুল্মদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে।

কিঙ্গ বলেছেন, প্রথমে, সে রকম একটা জায়গা বাছতে হবে।  তার পর সেখানে কাটাতে হবে ঘন্টা দুয়েকের নির্ভেজাল কর্মহীন সময়। সঙ্গে মোবাইল ফোন বা ক্যামেরা রাখা চলবে না। রাখা চলবে না এমন কোনও জিনিস যা প্রকৃতি থেকে আপনার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে। কারণ, আপনাকে আপনার পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে হবে প্রকৃতিকে। যাতে আপনার শরীরের প্রতিটি কোষে সঞ্চারিত হয় তার প্রভাব। সে জায়গাটি যে, জলদাপাড়ার জঙ্গল বা হিমালয়ের ফুলের উপত্যকা হতে হবে তাও নয়। আপনার বাড়ির কাছে, গাছে-ঢাকা কোনও পার্কও হতে পারে সেটি। বা আপনার ছোটবেলার দেশের বাড়ির সেই পুকুর পাড়ের বাঁশ বন, বা আম, জাম, কাঁঠালের ছায়াঘন বাগান, বা শাল, সেগুনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে চলা সেই রাঙা মাটির পথ, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আপনার শৈশবের নানা সুখকর স্মৃতি।

‘টাইম’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক লেখায় কিঙ্গ লি বলেছেন একাধিক গবেষণায় উনি দেখেছেন অরণ্য-স্নান অনেক শারীরিক সমস্যা কমিয়ে দেয় বা নিয়ন্ত্রণে রাখে। যেমন পাল্স রেট কমায়। সেই সঙ্গে অবসাদ, ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা ও বিভ্রান্তি কমিয়ে শরীরকে চাঙ্গা করে তোলে। এও দেখা গেছে যে, সপ্তাহে কিছুটা সময় অরণ্য-স্নান করলে বেশ কয়েকটি হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে আর কয়েকটির পরিমাণ বাড়ে, যার ফলে শরীর সুস্থ থাকে।

তাছাড়া, গাছেরা বাতাসে ‘ফাইটনসাইড’ নামের এক যৌগ ছড়ায়। কিঙ্গ’র মতে আমাদের শরীরে তার ইতিবাচক প্রভাব অপরিসীম। ওই ফাইটনসাইড এক ধরনের শ্বেতকণিকার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ওই শ্বেতকণিকাদের আমাদের শরীরের সৈন্য বলা যেতে পারে। দেখা গেছে, ক্যানসার কোষগুলিকে তারা আক্রমণ করে মেরে ফেলে। আর সেই ভাবে ওই মারাত্মক অসুখটিকে বশে রাখতে সাহায্য করে তারা। কিঙ্গ তেমনটাইদেখেছেন তাঁর গবেষণায়। তাছাড়া, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ার ফলে, নানা ধরনের ভাইরাস আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি আরও জোরদার হয়ে ওঠে।

কিঙ্গ লির মতে এটাই হওয়া স্খাভাবিক। কারণ, মনে করা হয়, এই গ্রহে মানুষের আবির্ভাব হয়েছিল দু’লক্ষ বছর আগে। এই সময়ের বেশিটাই তো মানুষ গাছেদের ঘেরাটোপে কাটিয়েছে, তা সে নিবিড় বৃক্ষরাজির মধ্যেই হোক বা সাভানার ঘাসের প্রান্তরে। তাই মানুষের বিবর্তনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে গাছ। সেই কারণেই গাছের কাছাকাছি এলেই উজ্জীবিত বোধ করি আমরা। এবং আমাদের এক অদ্ভূৎ ভালাগার অনুভূতি হয়।

আসলে ইঁট-কাঠের জঙ্গলে তো আমরা প্রবেশ করেছি এই সেদিন।  

 

Comments

Popular posts from this blog

হাওয়া বদল আনল ডাইনোসরদের

গঙ্গা রহস্য

জল, স্থল, অন্তরিক্ষ ভরে উঠছে জঞ্জালে